বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১০:২৮ পূর্বাহ্ন
দৈনিকবিডিনিউজ৩৬০ ডেস্ক : সলিম উম্মাহর ধর্মীয় জীবনে মসজিদের প্রভাব অপরিসীম। মুসলিম সমাজের জ্ঞানচর্চা, ধর্মীয় অনুশীলন থেকে শুরু করে সামাজিক ঐক্য ও সম্মিলিত কর্মকা’ণ্ডের অনেকটাই মসজিদের ওপর নির্ভরশীল। মসজিদ ধর্মীয় কর্মকা’ণ্ডের উৎসভূমি। এটি মুসলমানদের আশ্রয়স্থল। মুসলমানরা দিনে পাঁচবার মসজিদে যায়। সেখানে সালাত আদায় করে। তারা মসজিদে আল্লাহর কাছে দয়া, ক্ষমা, জা’হান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে।
মসজিদ যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাতিঘর, তেমনি ইবাদত-বন্দেগির মিহরাব। তাই মসজিদ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি’করণ এবং সর্বোপরি যেকোনো চাহিদা পূর্ণ করে আল্লাহর ঘরের তত্ত্বাবধান করা প্রত্যেক মুসলিম সমাজের নৈ’তিক দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে প্রথম করণীয় হলো, যথাসম্ভব মসজিদ আবাদ রাখতে হবে। আল্লাহর ইবাদত ও দ্বিনি কর্মকা’ণ্ডের মাধ্যমে তা প্রাণবন্ত করে রাখতে হবে।
ইসলামের সোনালি যুগে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে শুরু করে সামাজিক বিচার ও যু’দ্ধের পরামর্শ পর্যন্ত সব কাজ মসজিদে অনুষ্ঠিত হতো। মসজিদে নববী ছিল মহানবী (সা.)-এর সচিবালয়ের মতো। এ জন্য কোরআনে মসজিদের ব্যাপারে ‘আবাদ’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মসজিদ আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১৮)
মসজিদ আল্লাহর ঘর। আল্লাহর ইবাদত ও দ্বিনি কাজই শুধু সেখানে অনুমোদিত। ইসলামী শরিয়তবি’রোধী এবং ইবাদতের পরিবেশ ন’ষ্ট হয় এমন কোনো কাজ মসজিদে করা যাবে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মসজিদগুলো আল্লাহর জন্য। সুতরাং আল্লাহর সঙ্গে কাউকে ডেকো না।’ (সুরা : জিন, আয়াত : ১৮)
মসজিদ পরিচ্ছন্ন রাখাও মুসলিম সমাজের দায়িত্ব। মসজিদে ময়লা আ’বর্জনা ফেলবে না এবং কোনো ময়লা চোখে পড়লে তা নিজ থেকে পরিষ্কার করা উচত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মসজিদে থু’থু ফেলা পাপ। এ পাপের মার্জনা হলো তা পরি’ষ্কার করা।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ১৬৩৭)
ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে মসজিদের ব্যাপারে ছয় শ্রেণির মানুষ দায়িত্বশীল। তাঁরা হলেন ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম, মক্তব-পরিচালক, কমিটি ও দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা। প্রত্যেকের ওপর নির্ধারিত কিছু দায়িত্বও রয়েছে। যেমন—ইমাম যথাযথভাবে নামাজ করবেন এবং মুসল্লিদের দ্বিনি জ্ঞা’ন, ঈমান ও আমলের উন্নয়নের চিন্তা করবেন। মুয়াজ্জিন যথাসময়ে আজান দেবেন। ইমামকে সহযোগিতা করবেন।
খাদিমরা নিজ নিজ কাজ সম্পন্ন করবেন। মক্তব-পরিচালক মুসলিম শিশুদের ফরজ শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করবেন। কমিটি ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মসজিদ ও মুসল্লিদের প্রয়োজনগুলো পূরণের চে’ষ্টা করবেন। মসজিদের সার্বিক পরিচালনার ক্ষেত্রে ইমামকে পরামর্শ দেবেন এবং তাঁর থেকে পরামর্শ নেবেন। (আহকামুল মাসাজিদ ফিশ-শারিয়াতিল ইসলামিয়া, পৃষ্ঠা : ৪০৫-৮)
মসজিদ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। মসজিদ পরিচালনাকারী মানুষগুলোর বৈশি’ষ্ট্য সম্পর্কে কোরআনের এক আয়াত থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে সেই সব লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্ম’রণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩৬-৩৭)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, এমন মানুষের তত্ত্বাবধানে মসজিদ পরিচালিত হওয়া জরুরি, যাদের সঙ্গে মসজিদের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রচিত হয়েছে, যারা সুখে-দুঃখে সব সময় মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে। ইবাদত ও আমলের মাধ্যমে মসজিদকে আবাদ রাখে।মসজিদকে সমুন্নত রাখা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ। মসজিদকে সমুন্নত রাখার অর্থ হলো, যে উদ্দেশ্যে মসজিদের নির্মাণ সে উদ্দেশ্য যথার্থভাবে বাস্ত’বায়নের ব্যবস্থা করা।
মসজিদ নির্মাণ করা, সংস্কার করা, সম্প্র’সারণ করা, ইবাদত-বন্দেগির পরিবেশ সৃষ্টি করা। যোগ্য ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেম নিয়োগ দেওয়া, তাঁদের সম্মানজনক সম্মানীর ব্যবস্থা করা, মসজিদকেন্দ্রিক দ্বিনি শিক্ষার ব্যবস্থা করা, এক কথায় সুচারু’রূপে মসজিদ পরিচালনা করার সব বিষয়ই মসজিদ সমুন্নত করার অন্তর্ভু’ক্ত। মুসলমান মাত্রই মসজিদের নির্মাণ, পরিচালনা বা র’ক্ষণাবেক্ষণের যেকোনো পর্বে অংশ নিতে পারাকে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করেন। তাই বলে সামাজিকভাবে মুসলমান দাবি করলেই কেউ মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন না।
তাঁকে ন্যূনতম কিছু বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতার অধিকারী হতে হয়। ওপরে উল্লিখিত আয়াতে সেসব বৈশি’ষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মসজিদ আবাদ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘মসজিদ আবাদের অর্থ কেবল তার চাকচিক্য ও বাহ্যিক সৌন্দর্যবর্ধনই নয়, বরং মসজিদ আবাদ করার অর্থ তাতে আল্লাহর আলোচনা করা, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং মসজিদকে সব ধরনের শি’রক ও পা’প-প’ঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা।’ (ইবনে কাসির : ১/২৭০)
আল্লাহর ঘর মসজিদের দেখাশোনা করা, পবিত্রতা রক্ষা করা, পরিচালনা করা এবং মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা সাওয়াবের কাজ। অন্যদিকে মসজিদ পরিচালনা করতে গিয়ে যদি কেউ অ’নৈসলামিক কাজ করে তার পরিণামও খুব খারাপ। তাই মসজিদ কমিটির দায়িত্ব সম্পর্কে জানা কমিটির সদস্যদের জন্য ফরজ, যেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আল্লাহর ঘর নিয়েই তারা পাপে জড়িয়ে না যায়।
সুতরাং অমুসলিমরা যেমন মসজিদ পরিচালনায় যুক্ত হতে পারে না, তেমনি ইসলামের শর্তভ’ঙ্গকারী কোনো মুসলিমও মসজিদ কমিটির সদস্য হতে পারে না। কারো সামাজিক ক্ষমতা বা আর্থিক প্রতিপত্তি থাকলেই তাকে মসজিদ পরিচালনার যোগ্য ভাবা সংগত নয়। মসজিদের চেতনার সঙ্গে সাংঘ’র্ষিক পেশা বা স্বভাবের কেউ মসজিদ কমিটির যোগ্য হতে পারে না।
মসজিদে বহু মত, শ্রেণি ও পেশার মানুষ আসে। সবার শিক্ষা, আচার-ব্যবহার ও কার্যকলাপ যথার্থ নাও হতে পারে। কিন্তু মসজিদের সমস্যা সমাধান করতে হবে হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে। কারো সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না যে সে মসজিদবিমুখ হয়ে পড়ে। মসজিদ পরিচালনাকারীদের নিম্নোক্ত হাদিস জানা থাকা জরুরি। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার এক বেদুঈন মসজিদে প্রস্রাব করে দিল।
তখন লোকজন তাকে শাসন করার জন্য উত্তে’জিত হয়ে পড়ল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের বলেন, তোমরা তাকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রস্রাবের ওপর এক বালতি পানি অথবা এক পাত্র পানি ঢেলে দাও। কেননা তোমাদের নম্র ব্যবহারকারী বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, কঠোর ব্যবহারকারী হিসেবে পাঠানো হয়নি। (বুখারি, হাদিস : ৬১২৮)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, লোকটি প্রস্রাব শেষ করলে মহানবী (সা.) লোকটিকে ডেকে বলেন, ‘দেখো, এসব মসজিদ প্রস্রাবের জন্য বানানো হয়নি। এটাকে বানানো হয়েছে ইবাদত-বন্দেগি, তাসবিহ-তাহলিল করার জন্য।’ অতঃপর তিনি সাহাবায়ে কেরামকে এক বালতি পানি ঢালতে বলেন।
দেখুন, মহানবী (সা.) মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণে কিভাবে হেকমত অবলম্বন করেছেন। এটাই মসজিদ পরিচালনার সর্বশ্রেষ্ঠ মূলনীতি। মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।
এনএস